একদল উন্মত্ত জনতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত আক্রমণের শিকার হয়েছে দুই পত্রিকা # নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির লাঞ্চিত
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির অন্যতম নেতা ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এ ঘটনায় ডেইলি স্টার ভবনের ভেতরে আটকা পড়েন অন্তত ২৮ জন সাংবাদিক ও কর্মী। প্রায় চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর আজ শুক্রবার ভোরে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদেরকে ছাদ থেকে উদ্ধার করেন।
প্রথম আলোর অনলাইনের খবরে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে ১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকার কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর অফিস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত আক্রমণের শিকার হয়েছে। আক্রমণকালে কর্মরত সাংবাদিকেরা অনলাইন সংবাদ–পোর্টাল চালানোর পাশাপাশি ১৯ ডিসেম্বরের কাগজ প্রকাশের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথম আলোর কর্মীরা এই সন্ত্রাসী হামলার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন এবং জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা অফিসের ভবন ব্যাপকভাবে ভাঙচুরের পরে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবন পুড়ে যায় এবং তাতে সংরক্ষিত সম্পদ ও মূল্যবান নথিপত্র ভস্মীভূত হয়।

আর ডেইলি স্টারের অনলাইন খবরে বলা হয়েছে, স্বাধীন সাংবাদিকতার ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্য এক কালো দিন ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন দেশের শীর্ষ দুই দৈনিক—দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো—ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েছে। আমাদের সহকর্মীরা যখন ছাদে আটকা পড়ে নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কায়, তখন নিচে একদল উন্মত্ত জনতা একের পর এক ফ্লোরে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধোঁয়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় কেউ হতাহত হননি এবং সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজধানীর পল্টনে গুলিবিদ্ধ হন হাদি। গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। হাদির মৃত্যুর খবর আসার কয়েক ঘণ্টা পরই দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা চালায় একদল উন্মত্ত জনতা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১২টার দিকে ১০০ থেকে ২০০ জনের একটি দল ডেইলি স্টারের প্রধান ফটক ভেঙে ভবনের নিচতলায় ঢুকে পড়ে। তারা আসবাব, গ্যালারি ও কাঁচের দরজা ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে নিচতলায় থাকা আসবাব ও সংবাদপত্রের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই আগুন ভবনের তৃতীয় তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
আগুন থেকে বাঁচতে সাংবাদিক ও কর্মীরা ছাদে আশ্রয় নেন। ভবনের ভেতরে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র রিপোর্টার জায়মা ইসলাম রাত একটার দিকে ছাদ থেকে ফেসবুকে লেখেন, 'আমি শ্বাস নিতে পারছি না। প্রচুর ধোঁয়া। আমি ভেতরে আটকা পড়েছি। আপনারা আমাকে মেরে ফেলছেন।'
হামলাকারীরা ভবনের প্রথম থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত উঠে ভাঙচুর চালায়। এ সময় কম্পিউটার, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম লুট করা হয়। ক্যানটিনের খাবারও নিয়ে যায় তারা। হামলাকারীরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে শুরুতে ডেইলি স্টার ভবনের কাছে যেতে বাধা দেয়। এতে উদ্ধারকাজ বিলম্বিত হয়।
বিক্ষোভকারীরা রাত ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করে। তারা দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে হাদি হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী হিসেবে দায়ী করে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। পত্রিকা দুটিকে 'দিল্লির দালাল' ও 'শেখ হাসিনার সহযোগী' বলেও আখ্যায়িত করে তারা, যা দ্য ডেইলি স্টার দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
দ্য ডেইলি স্টারের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মাহমুদুল হাসান খান বলেন, 'আগুন নিচতলা থেকে ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়লে আমাদের ২৮ জন কর্মী ছাদে আশ্রয় নিয়ে লোহার দরজা ভেতর থেকে আটকে দেন। আজ শুক্রবার ভোর পাঁচটার দিকে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেন।'
তিনি আরও জানান, হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হামলাকারীরা নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত প্রায় সবকিছু পুড়িয়ে ও ভেঙে দিয়েছে। কম্পিউটার, টেবিল, চেয়ার, সোফা, ক্যামেরার লেন্সসহ অফিসের বিভিন্ন সরঞ্জাম ভাঙচুর করা হয়েছে। বর্তমানে ভবনে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস নেই।
চার ঘণ্টা ধরে চলা এই হামলা ও বিক্ষোভের সময় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। হামলার খবর পেয়ে নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির, প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা নাহিদ ইসলাম, নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী, সামান্তা শারমিন, নাহিদা নিভা, মনিরা শারমিন এবং সাবেক তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও সাবেক ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা হামলাকারীদের সহিংসতা পরিহার করে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আরেক নেতা সালেহ উদ্দিন সিফাতের ফেসবুক পোস্ট অনুযায়ী, তৃতীয়বারের চেষ্টায় তারা হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে সক্ষম হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবিরকে লাঞ্ছিত করা হয়।
হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি। আজ সকালে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
প্রথম আলোর অনলাইনের খবরে আরো বলা হয়েছে, প্রথম আলো অফিস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাওয়ায় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বিভিন্ন বাহিনীসহ নানা মহলের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই অফিস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কর্মরত উদ্বিগ্ন সাংবাদিক ও কর্মীরা জীবন বাঁচাতে কার্যালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এই হামলা, ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরের ইতিহাসে, কোনো সংবাদপত্র–জনিত ছুটি বাদে, পত্রিকাটি এই প্রথম আজ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। একই কারণে প্রথম আলো অনলাইনের কার্যক্রমও দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখতে হয়।
একই রাতে দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ও সন্ত্রাসী আক্রমণ, ভাঙচুর ও অগ্নি–সংযোগের শিকার হয়। এ কথা বিশ্বাস করার সংগত কারণ আছে যে শরিফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ছিল একটি কালো দিন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুধু আগামী নির্বাচনকে পথভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টাই চালানো হয়নি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করারও লক্ষ্য ছিল।
এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের প্রকাশের অধিকারের ওপর সরাসরি আক্রমণের একটি সুস্পষ্ট নজির। আমরা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানাই। আমরা যথাসম্ভব দ্রুত প্রথম আলোর অনলাইন কার্যক্রম শুরু করব। আগামীকাল থেকে যথারীতি পত্রিকাও প্রকাশিত হবে। আমরা সব সময়ের মতো প্রথম আলোর পাঠকদের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করছি।
অটুট মনোবলে এগিয়ে যাবে দ্য ডেইলি স্টার
ডেইলি স্টারের খবরে আরো বলা হয়, এর আগে শাহবাগের ঘটনা এবং কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের অভিমুখে একদল লোক আসার খবর পেয়ে দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে যোগাযোগ করে। তারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঘটনাস্থলে সহায়তা করেন। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ছাদে আটকে পড়া আমাদের সহকর্মীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ে কাটাতে হতো না।
গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অগ্রসেনানী শরিফ ওসমান হাদির অকালমৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, একটি বিশেষ মহল এই জনরোষকে কাজে লাগিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে থাকা দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির আরেকটি অপচেষ্টা বলে আমরা একে মনে করছি।
পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে হামলাকারী ও তাদের ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। হাদির ওপর গুলির ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের ওপর এমন সহিংসতা কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
গণমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের শিথিল মনোভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অতীতেও দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো বিভিন্ন মহলের হুমকির মুখে পড়েছে, কিন্তু সেসব ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়নি। চরম ঝুঁকির মধ্যেও যারা আমাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন, এমনকি শারীরিক হামলার শিকার হয়েও পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত চলা এই হামলা শুধু দুটি পত্রিকার ওপর হামলা নয়; এটি স্বাধীন সাংবাদিকতা, বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর আঘাত। এই ঘটনাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা আমাদের পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সমালোচকদের আশ্বস্ত করতে চাই—আমাদের পথচলা থামবে না। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার প্রতি আমাদের অবিচল বিশ্বাস অটুট থাকবে। ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিতে আমাদের অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে। স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি আমাদের নিষ্ঠা থাকবে অবিচল।