এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ : ফাইল ছবি
ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে নয়াদিল্লি # আমাদের ‘নসিহত’করা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে উপদেশ চাই না: তৌহিদ হোসেন # শেখ হাসিনাকে ফেরত না দিলে ভারতীয় হাইকমিশনে ঢুকে পড়ার হুঁশিয়ারি জুলাই ঐক্যের
বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে নয়াদিল্লি। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ঢাকায় ভারতীয় মিশন ও বিভিন্ন স্পটের নিরাপত্তা উদ্বেগ জানাতেই হামিদুল্লাহকে তলব করা হয়েছে। তবে দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপড়েনের জন্য ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদিকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যকে প্রসঙ্গ করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। রিপোর্টে বলা হয়, হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যকে ঘিরেই ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক টানাপড়েনের সূত্রপাত হয়েছে। এই নেতা তার বক্তব্যে বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টার্সকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে এবং ঢাকায় ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে আশ্রয় দেয়া হবে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে যা আছে-
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ঢাকার ক্রমাবনত নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশন ঘিরে ঘোষণা দেয়া ‘চরমপন্থি’ তৎপরতার বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের সামপ্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘চরমপন্থি মহল’ যে ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বর্ণনা তৈরির চেষ্টা করছে, ভারত তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। পাশাপাশি অভিযোগ করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করেনি কিংবা ভারতের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও ভাগাভাগি করেনি। বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা ভারত-বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ ও জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ভারত সব সময়ই সোচ্চার। কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে সকল কূটনৈতিক মিশন ও পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে নয়াদিল্লি।
সেভেন সিস্টার্স নিয়ে মন্তব্য
ভারত-বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপড়েনের সূত্রপাত বাংলাদেশের জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক নেতার বক্তব্যকে ঘিরে। ইনকিলাব মঞ্চ কর্তৃক আয়োজিত সর্বদলীয় প্রতিবাদ সমাবেশে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টার্সকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে এবং ঢাকায় ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকে আশ্রয় দেয়া হবে। তিনি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলাকারীদের ভারত মদত দিয়েছে বলে জোর দেন। এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যেন দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবের উত্থান
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশ একটি অস্থির পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ‘ইসলামী চরমপন্থা’র উত্থান হচ্ছে এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তানের প্রতি অনুরাগী হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ এই পাকিস্তানই ১৯৭১ সালে লাখ লাখ বাংলাদেশির ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম থেকে ক্রমাগত ভারতবিরোধী বক্তব্য আসছে। এমনকি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সম্পর্কেও উস্কানিমূলক মন্তব্য করা হচ্ছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল মূলত ওই অঞ্চল সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু মন্তব্যের পর। গত বুধবার অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আসামের কাছাড় জেলা প্রশাসন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় ১৪৪ ধারা (নিষেধাজ্ঞা) জারি করেছে। ভারত সরকারের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ‘চরমপন্থিদের’ সম্ভাব্য আনাগোনা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করতে পারে এমন অননুমোদিত আন্তঃসীমান্ত কর্মকাণ্ডের আশঙ্কায় সংবেদনশীল সীমান্ত এলাকায় এই প্রতিরোধমূলক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

ভারতের বক্তব্য নিয়ে তৌহিদ হোসেনে প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে ‘নসিহত’ করা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে উপদেশ চাইছে না বাংলাদেশ। বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, এটা নিয়ে আমরা প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না। এখন সামনে আমরা একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে তো আমাদের নসিহত করার তো কোনো প্রয়োজন নেই।’
এর আগে সকালে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে কী কথা হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে।
জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘সর্বশেষ যে বক্তব্য (ভারতের) এসেছে, তাতে আমাদের নসিহত করা হয়েছে। সেটার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, এটা নিয়ে আমরা প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এই সরকার ডে ওয়ান (প্রথম দিন) থেকে স্পষ্টভাবে বলে আসছে যে আমরা “অত্যন্ত উঁচু মানের”...মানুষ যেন ভোট দিতে যায়, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, যে পরিবেশ গত ১৫ বছর ছিল না। ভারত আমাদের এটা (নির্বাচন) নিয়ে উপদেশ দিচ্ছে। এটাকে আমি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মনে করি। তারা (ভারত) জানে এর আগে গত ১৫ বছর যে সরকার ছিল, তাদের সঙ্গে (ভারতের) অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক হয়েছিল, সে সময় তারা (ভারত) একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন সামনে আমরা একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে তো আমাদের নসিহত করার তো কোনো প্রয়োজন নেই।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা কী করব? আমরা এমন একটা নির্বাচন করব, যেখানে মানুষ ভোট দিতে পারবে। যাদের ভোট দেবে, তারাই নির্বাচিত হবে, যেটা এর আগে গত ১৫ বছরে ঘটেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছে। তাহলে তো তারাও ভারতের মতো নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছে বলা হলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বিষয়টা কিন্তু এক রকম না। তাদের সঙ্গে আমাদের কিছু যোগাযোগ সব সময় আছে এবং তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও যোগাযোগে আছে। কারণ, আমরা চাই যে তারা এখানে তাদের অবজারভারদের (নির্বাচন পর্যবেক্ষক) পাঠাক।’
এ পর্যায়ে ভারতের বক্তব্য নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সেটা কিন্তু এভাবে একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে যে আমাদের অবস্থানটা গ্রহণযোগ্য না। এ ধরনের কথাবার্তার পাশাপাশি বলা যে এ রকম হতে হবে নির্বাচন। এই নসিহত আমরা গ্রহণ করতে পারি না। বিশেষত এ কারণে যে তাদের তো এই সেন্টিমেন্টটা (মনোভাব) দেখা যায়নি গত ১৫ বছর। হঠাৎ করে এটা কেন তারা চেয়ে বসল?’

ওসমান হাদির ওপর হামলাকারী ও শেখ হাসিনাকে
ফেরত না দিলে হাইকমিশনে ঢুকব
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দ্রুত ফিরিয়ে না দিলে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই ভারতীয় হাইকমিশনে ঢুকে পড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে জুলাই ঐক্য।
বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে এ হুঁশিয়ারি দিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচি শেষ করেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংগঠনের মোর্চা ‘জুলাই ঐক্য’।
বেলা তিনটার দিকে রাজধানীর রামপুরা থেকে জুলাই ঐক্যের সংগঠকদের নেতৃত্বে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি বিকেল চারটার দিকে বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। পরে সেখানেই সড়কে বসে পড়েন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা। এরপর সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘ভারতীয় আধিপত্য, মানি না, মানব না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়। এ সময় তাঁদের হাতে ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী নানা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
আজকের কর্মসূচিতে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু ও জাকসু) একাধিক নেতা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
ভারতের সঙ্গে থেকে যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায়, তাদের ‘সাবধান করে দিয়ে’ ইসরাফিল ফরাজি বলেন, ‘আজ আমরা থেমে যাচ্ছি, সামনে আমাদের থামানোর ক্ষমতা প্রশাসন দেখাতে পারবে না। আজ আমরা হাজারে এসেছি, সামনে লাখে আসব। শেখ হাসিনাসহ সকল খুনিদের যদি ফিরিয়ে দেওয়া না হয়, তাহলে সামনের দিনগুলো ভারতের জন্য ভালো হবে না।’
কর্মসূচিতে জুলাই ঐক্যের সংগঠক ও ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক যুবাইর বিন নেছারী ওরফে এ বি জুবায়ের বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি, (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) কান খুলে শুনে রাখো, যদি তোমাদের আগ্রাসন বন্ধ না হয়, যদি আর সীমান্তে গুলি চলে, যদি আমাদের দেশের খুনিদের আশ্রয় দাও, হাসিনাকে ফেরত না দাও; তাহলে তোমাদের আধিপত্যবাদ বন্ধ করার জন্য আমরা যা যা করা দরকার, সেটিই করব।’
এ সময় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে এ বি জুবায়ের বলেন, ‘আজকে আমরা তোমাদের প্রতি আমাদের যে ঘৃণা, সেই ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য হাইকমিশন পর্যন্ত এসেছি। আজকে এখানে থেমেছি; যদি তোমরা সংশোধন না হও, তাহলে ভেতরেও (হাইকমিশন) ঢুকব।’